মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী যুদ্ধে সবচেয়ে বড় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর একটি ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি (ইউডব্লিউএসএ)। গত কয়েক বছর উত্তর মিয়ানমারের শান রাজ্যের এ গোষ্ঠীটি বিভিন্ন জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন ও প্রতিরোধ বাহিনীকে অস্ত্র, অর্থ ও নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে সহায়তা করে আসছিল। শান স্টেট প্রগ্রেস পার্টি (এসএসপিপি), তা’আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) থেকে শুরু করে আরাকান আর্মিকেও (এএ) অর্থায়ন করে আসছিল সংগঠনটি। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর গড়ে ওঠা স্প্রিং রেভল্যুশনের বিভিন্ন ছোট ছোট ইউনিটকেও সহায়তা করে আসছিল ইউডব্লিউএসএ। সম্প্রতি সংগঠনটি ঘোষণা দিয়েছে, তারা আর কোনো সশস্ত্র বা আর্থিক সহায়তা দেবে না। বিশ্লেষকদের মতে, এ সিদ্ধান্ত স্বেচ্ছায় নয়, বরং চীনের পরিকল্পিত আর্থিক অবরোধ কৌশলের ফল। প্রায় দুই বছর আগে থেকেই সংগঠনটির নেতাদের বিলিয়ন ইউয়ান জব্দ করে চীন। ব্যাংক লেনদেন সীমিত করে। সম্প্রতি খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানি সরবরাহ বন্ধের হুমকি দেয়। এতে ওয়া অঞ্চলের প্রায় পাঁচ লাখ বাসিন্দার ওপর মানবিক সংকটের আশঙ্কা তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত ইউডব্লিউএসএ চীনের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে। ওয়া বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চলের অর্থনীতি মূলত চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ও আর্থিক লেনদেনের ওপর নির্ভরশীল। এখানকার টিন খনির উৎপাদন প্রায় সম্পূর্ণটাই রফতানি হয় চীনে, যা থেকে ইউডব্লিউএসএ বিপুল আয় করে। এছাড়া তাদের নেতৃত্ব ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা চীনা ব্যাংকে বিলিয়ন ইউয়ান জমা রেখেছে। এ ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্কই ইউডব্লিউএসএর ওপর চাপ প্রয়োগের বড় হাতিয়ার করে তুলেছে বেইজিং। জান্তাবিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসায় উত্তর মিয়ানমারের সশস্ত্র প্রতিরোধ শিবিরে বড় ধরনের ধাক্কা আসতে পারে। অস্ত্র ও অর্থের জোগান কমে গেলে ফ্রন্টলাইনে সক্রিয় অনেক গোষ্ঠী দুর্বল হয়ে পড়বে। একই সঙ্গে চীনের এ হস্তক্ষেপ মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে ক্ষমতার ভারসাম্য পাল্টে দিতে পারে, যেখানে বেইজিংয়ের কৌশলগত প্রভাব আরো সুদৃঢ় হবে।
ইরাওয়াদ্দির খবরে বলা হয়েছে, ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি গত মাসে ঘোষণা দেয় তারা জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে আর কোনো সামরিক বা আর্থিক সহায়তা দেবে না। এ সিদ্ধান্ত হঠাৎ আসেনি। এর পেছনে রয়েছে সেনাবাহিনী ও চীনের দীর্ঘদিনের চাপ, যা শেষ পর্যন্ত সংগঠনটিকে তাদের ভূমিকা পুনর্বিবেচনায় বাধ্য করেছে। এর আগেও এমন পরিস্থিতি দেখা গিয়েছিল। ১৯৮৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টি অব বার্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে অস্ত্রবিরতি করে ইউডব্লিউএসএ। নব্বইয়ের দশক ও ২০০০ সালের শুরুতে তারা সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে মং তাই আর্মি এবং পরে রেস্টোরেশন কাউন্সিল অব শান স্টেটের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। এতে সেনাবাহিনী প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠী দুর্বল করার সুযোগ পায়। আর ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি দক্ষিণ সীমান্তে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ শক্ত করে।
সে সময় সামরিক গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল খিন ন্যুন্ট ইউডব্লিউএসএর সঙ্গে সম্পর্ক মসৃণ রাখলেও জান্তার দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি মং আয়ে তাদের স্বায়ত্তশাসিত অবস্থান পছন্দ করতেন না। ২০০৫ সালে খিন ন্যুন্টকে অপসারণ এবং সংগঠনের ব্রিগেড কমান্ডার বাও আইক খামকে গ্রেফতারের ঘটনায় ইউডব্লিউএসএর সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ২০০৯ সালে সেনাবাহিনী ২০০৮ সালের সংবিধান অনুযায়ী ইউডব্লিউএসএকে বর্ডার গার্ড ফোর্সে রূপান্তরের চাপ দেয়, যা তারা প্রত্যাখ্যান করে। ২০১০ সালে সরকারি কর্মীরা ওয়া অঞ্চল থেকে সেবা প্রত্যাহার করে নেয় এবং বিরোধপূর্ণ এলাকায় সেনা ঘাঁটি স্থাপন করে।
প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের সময়ে রাজ্য ও ইউনিয়ন স্তরে অস্ত্রবিরতি চুক্তি হলেও ২০১৫ সালে জাতীয় অস্ত্রবিরতি চুক্তিতে সই না করায় সম্পর্ক আবার খারাপ হয়। এর পর সেনাবাহিনী বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির সহায়তা বন্ধ করে দেয়, যার মধ্যে চাল ও জ্বালানি ছিল। জবাবে তারা সাতটি জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীর সমন্বয়ে ফেডারেল পলিটিক্যাল নেগোসিয়েশন অ্যান্ড কনসালটেটিভ কমিটি গঠন করে। ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি এ সময় আরাকান আর্মিসহ বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে অস্ত্র, অর্থ ও নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে সহায়তা করে। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পরও ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি জান্তার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখে। ২০২২ সালে সংগঠনটি নেপিদোতে জান্তা আয়োজিত শান্তি আলোচনায় যোগ দিলেও কোনো চুক্তি করেনি।
অভ্যুত্থানের আগে ওয়া অঞ্চলের টিন উৎপাদনের একমাত্র ক্রেতা ছিল চীন। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর সীমান্ত শহরগুলো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হাতে গেলে বাণিজ্য বিঘ্নিত হয়। শুরুতে স্থানীয় ছোট কয়েকটি গোষ্ঠীকে যুদ্ধ থামাতে চাপ দেয় বেইজিং। সে চেষ্টা ব্যর্থ হলে সরাসরি ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মিকে লক্ষ্যবস্তু করে তারা। চীনের ব্যাংকে সংগঠনের নেতাদের বিলিয়ন ইউয়ান জব্দ করা হয়। ডেপুটি কমান্ডার বাও জুনফেংকে প্রতারণা অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। ৭০ বছর বয়সী প্রধান কমান্ডার বাও ইউশিয়াংয়ের দলটির উত্তরসূরি হওয়ার কথা ছিল। এতে নেতৃত্ব বদল প্রক্রিয়া ভেঙে পড়ে। প্রায় দুই বছর আর্থিক অবরোধের পর চীন খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানিসহ প্রয়োজনীয় পণ্যের ওপরও অবরোধ আরোপের হুমকি দিলে পাঁচ লাখ জনসংখ্যার ওয়া অঞ্চলে মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত চীনের দাবির কাছে নতি স্বীকার করেছে ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি কোনো কৌশলগত পরিবর্তন নয়, বরং চীনের চাপের মুখে নেয়া অনিচ্ছুক সিদ্ধান্ত।
বিশ্লেষকদের মতে, এ পরিবর্তন উত্তর মিয়ানমারের ক্ষমতার ভারসাম্যে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। চীন ও মিয়ানমারের সামরিক জান্তা জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর সম্পর্কের নতুন সমীকরণ তৈরি করতে পারে। যদিও অনেকে বলছেন, ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মির সহায়তা প্রত্যাহার জান্তার সঙ্গে কোনো সহযোগিতার ইঙ্গিত নয়; বরং বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে নেয়া এক অনিচ্ছুক সিদ্ধান্ত। চাইলে তারা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য সহায়তা স্থগিতের কথা বলতে পারত। কিন্তু তারা সরাসরি জানিয়েছে চীনের চাপেই এ সিদ্ধান্ত। এমন খোলামেলা বক্তব্য বেইজিংকে সন্তুষ্ট করবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। ইউডব্লিউএসএ তাদের প্রভাবশালী প্রতিবেশীকে তুষ্ট করার চেয়ে স্থানীয় জাতিগত সম্প্রদায়গুলোর কাছে নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষা করাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, যে কারণে তারা চীনের চাপের বিষয়টি প্রকাশ্যে এনেছে।
পাঠকের মতামত